মুহম্মদ জাফর ইকবালকে বলা হয় এদেশের সাইন্সফিকশনের পুরোধা। তাঁর প্রথম কল্পবিজ্ঞানগ্রন্থ কপোট্রনিক সুখদুঃখের পেছনের গল্পটি জাঁক করে তিনি অনেক জায়গাতেই বলেছেন। আসুন, তাঁর মুখ থেকেই শুনি।
'প্রথম গল্পটি বিচিত্রায় প্রকাশিত হবার পর কেউ কেউ এটাকে বিদেশি গল্পের অনুকরণ বলে সন্দেহ প্রকাশ করে কাগজপত্রে লেখালেখি করেছিলেন। আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, অল্পতেই বিচলিত হয়ে যাই। বিদেশি গল্পের অনুকরণ না করেই সায়েন্স ফিকশান লেখা সম্ভব প্রমাণ করার জন্যে আমি তখন রেগেমেগে অন্য গল্পগুলি লিখেছিলাম।'
(সূত্র: সায়েন্স ফিকশান সমগ্র)
তো, জাফর স্যার মৌলিক লেখালেখি করেন, এটা জেনে (এবং বিশ্বাস করে) যখন তাঁর একজন গুণমুগ্ধ ভক্তে পরিণত হচ্ছিলাম, তখনই ধাক্কাটা খেলাম।
খেয়াল করেছি, যারা বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি পড়েন, তারা নিয়মিত সাইফাই মুভিও দেখেন। ১৯৭৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত অ্যালিয়েন ছবির কাহিনির সঙ্গে 'ট্রাইটন একটি গ্রহের নাম' বইয়ের প্রায় হুবহু মিলটি নিশ্চয়ই আপনাদের চোখে পড়েছে! অনেকে বলবেন, অ্যাডাপ্টেশন। আমি বলব, চৌর্যবৃত্তি। কারণ, ঋণ স্বীকার করার কষ্টটুকু লেখক স্বীকার করেননি কোথাও। 'না বলিয়া পরের দ্রব্য লওয়া', আর স্বীকার না করে অন্যের গল্প নিজের বলে চালানোর মাঝে কোন পার্থক্য আছে কি? এটা বিশ্বাস করতে বলবেন না যে, ট্রাইটনের গল্পটি স্বপ্নে প্রাপ্ত। ইন্টারনেট মুভি ডাটাবেজে গেলে যে-কেউ নিশ্চিত হবেন, মূল কাহিনি ড্যান ও'ব্যানন এবং রোনাল্ড শাসেটের। জাফর স্যারের মত প্রযুক্তির মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করেন না, বা আইএমডিবির খবর রাখেন না, এটা তো বিশ্বাসযোগ্য নয়!
এখানেই শেষ নয়, তাঁর 'অবনীল' বইটি ভিন ডিজেল অভিনীত চলচ্চিত্র পিচ ব্ল্যাকের ছায়া অবলম্বনে লেখা, যেটির কাহিনিকার জিম ও কেন হুইট ভাতৃদ্বয়। কৃতজ্ঞতা স্বীকার? নৈবচ!
সেবা প্রকাশনীর বেশির ভাগ বইই বিদেশি কাহিনি অনুসরণ করে লেখা হয়, এটা ওপেন সিক্রেট। তার পরও তাদের প্রতিটি বইয়ের শুরুতেই উল্লেখ থাকে: বিদেশি কাহিনি অবলম্বনে। পেপারব্যাক প্রকাশনী, তথাকথিত সুশীল সাহিত্যিকদের চোখে যারা একরকম 'অচ্ছুৎ', তারা যদি ঋণ স্বীকারের উদারতাটুকু দেখাতে পারে, জাফর স্যারের মত মানুষ কেন পারেন না? এটা করলে কি তিনি ছোট হয়ে যেতেন?
আচ্ছা, সাইন্সফিকশন বাদ দিলাম, কিশোরোপন্যাসে আসি। ম্যাটিল্ডা আগেই দেখা ছিল, তাই আরও একবার চমকে উঠলাম 'নিতু আর তার বন্ধুরা' পড়ে। ছবিটি অবশ্য রোল্ড ডাহলের একই নামের উপন্যাস থেকে তৈরি। জাফর স্যার বই, না মুভি, কোনটা ফলো করেছেন, জানা নেই, তবে এটা জানুন যে, বইটির কোত্থাও তিনি মূল লেখককে কৃতিত্ব দেয়ার আশপাশ দিয়েও যাননি। লেখক এই বইটিকে পরে নাট্যরূপ দেন, সেখানেও একই ব্যাপার। 'সাত চার দুই' নামের সেই নাটকে খোরাসানী ম্যাডাম চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন প্রয়াত নাজমা আনোয়ার। তিনিও লেখকের লুকোছাপায় বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন একটি সাক্ষাৎকারে, যা দৈনিক প্রথম আলোয় প্রকাশিত হয়।
আরও আছে। 'মেকু কাহিনী'র কাহিনি বেবি'জ ডে আউট থেকে নেয়া। মূল লেখক জন হিউজেস। ডেভ পেলজারের আত্মজৈবনিক গ্রন্থ আ চাইল্ড কলড "ইট" অবলম্বনে লেখা 'আমি তপু'।
এই সব নির্লজ্জ চোট্টামির কারণে ইদানীং এই লেখকের বই পড়া বাদ দিয়েছি। কপোট্রনিকের নেপথ্যকাহিনি এখন জলজ্যান্ত এক প্রহসন ছাড়া কিছুই নয়।
জাফর স্যারের লেখার সাহিত্যমান নিয়ে কোন প্রশ্ন নেই। তাঁর অনেক বইই চোখে জল এনে দেয়ার যোগ্যতা রাখে, কিন্তু এই ছোটলোকিগুলো একজন লেখকের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নষ্ট করে দিতে যথেষ্ট। বলছি না যে, অন্যের লেখা থেকে ধার করাটা দোষের কিছু, কিন্তু মূল লেখককে ক্রেডিট না দেয়াটা মহা অন্যায়, পাঠকের সঙ্গে প্রতারণা করার শামিল।
স্যার, আপনি না পত্রিকায় কলাম লিখে নীতি শেখান? আপনার নিজের 'নীতি' যে পচে গলে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে, টের পান না বুঝি? মূলত শিশুকিশোররাই আপনার পাঠক। আপনি যা বলেন, যা লেখেন, এই সব খুদে ভক্তরা চোখ বুজে তা অনুসরণ করে। এদের নকলবাজি না শেখালে চলছে না, না?
লিখেছেন © ডিউক জন , বুধবার, ২৫ আগস্ট, ২০১০
0 comments:
Post a Comment